শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অভিযান আতঙ্ক তবুও মৌসুমী ভিক্ষুক বেড়েছে রাজধানীতে

news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় রমজানে রাজধানীতে যাকাত ফিতরাসহ দানের টাকা বেশি পাওয়া যায়— এই আশায় এবারও ঢাকার বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক ভিক্ষুক রাজধানীতে এসেছে। শহরের প্রধান প্রধান সড়কসহ অলিগলি, ফুটপাথ, ট্র্যাফিক সিগন্যাল বিপণিবিতান, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন মসজিদের সামনে মৌসুমী ভিক্ষুক বেড়েছে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

এদিকে মৌসুমী ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়ায় অভিযানের মাধ্যমে তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠাতে মাঠ নেমেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। গত ২ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৬৭ জন ভিক্ষুককে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ। ফলে বিভিন্ন এলাকায় এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ভিক্ষুকদের মধ্যে অভিযান আতঙ্ক বিরাজ করছে, তবুও রাজধানীতে রমজান মাসের প্রতিদিনই বাড়ছে মৌসুমী ভিক্ষুকের সংখ্যা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখতে পাওয়া এসব মৌসুমী ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই এসেছেন ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসব মৌসুমী ভিক্ষুকরা রাজধানীতে এসেছেন। রমজান মাসের শুরু থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত তারা রাজধানীতে অবস্থান করে, এরপরেই তারা নিজ এলাকায় ফিরে যায়। বেশিরভাগ জনেরই ভিক্ষা করা মূল পেশা না হলেও শুধু রমজান মাসে ঢাকা শহরে এসে ভিক্ষায় যুক্ত হন। পাশাপাশি অন্য জেলাতে যেসব ভিক্ষুকরা নিয়মিত ভিক্ষা করে, তারা কিছুটা বেশি টাকা পাওয়ার আশায় এই রমজান মাসে রাজধানীতে এসে ভিক্ষায় নেমে পড়েন।

একাধিক ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমী এসব ভিক্ষুকদের মূল টার্গেট থাকে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে ভিক্ষা করা। এর মধ্যে গুলশান, বনানী, নিকেতন, বারিধারা এলাকায় ঢুকে ভিক্ষা করতে পারলে প্রচুর পরিমাণে ভিক্ষা পাওয়া যায়। যে কারণে সবার টার্গেট থাকে এসব এলাকায় গিয়ে ভিক্ষা করার। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ভিক্ষুকদের বিরুদ্ধে অভিযানে তারা আতঙ্কিত হয়ে আছে। ‌এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন দেখছে কেউ নেই তখনই কেবল সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ির সামনে গিয়ে ভিক্ষা চাচ্ছেন তারা।

রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কে কথা হয় একজন মৌসুমী ভিক্ষুক নাসির‌ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহ, সেখানেই আমি ভিক্ষা করতাম। কিন্তু এই রমজান মাসে আমার এলাকার আরও পাঁচজন ভিক্ষুকের সঙ্গে রাজধানীতে এসেছি। এই সময় এখানে ভিক্ষা, যাকাত ফিতরার অনেক বেশি টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু এবার এসে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে না কারণ ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেশি। আর গুলশান বনানী বা এসব এলাকায় ভিক্ষা করতে ঢোকা যায় না, নতুন কাউকে তারা ঢুকতে দেয় না। কিন্তু আমার পরিচিত একজন আছে বলে আমি এখানে ঢুকে এই এলাকায় ভিক্ষা করছি। দু’একদিন বেশি টাকা পাওয়া যায় কিন্তু এখন ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি হয় সিগন্যালে গাড়ি পড়লেই সবাই ছুটে যায়, সে কারণে টাকার পরিমাণ একটু কমে গেছে। তবে এই ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল এখানেই, দুই দিন ধরে সিটি কর্পোরেশনের লোক এসে ভিক্ষুকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তাই কিছু কমে গেছে ভিক্ষুক। আমরাও ভয়ে আছি ধরা খাওয়ার।

টাঙ্গাইল থেকে স্ত্রীসহ রাজধানীতে ভিক্ষা করতে এসেছেন লাল মিয়া নামে একজন বয়োবৃদ্ধ। তিনি বলেন, এলাকাতেও নিয়মিত ভিক্ষা করি না, তবে রমজান মাসে রাজধানীতে ভিক্ষার অনেক টাকা পাওয়া যায়। এ কারণে এলাকার একজনের পরামর্শে স্ত্রীসহ ঢাকায় এসেছি। কড়াইল বস্তিতে আমার এক আত্মীয় থাকে ওখানেই উঠেছি আমরা। সারাদিন বনানীর বিভিন্ন এলাকায় আমি আর আমার স্ত্রী মিলে ঘুরি, যা টাকা পাওয়া যায় তাতেই খুশি। তবে রমজান মাসে মানুষ দান খয়রাত বেশি করার কারণে আমরা বেশ কিছু টাকা পাচ্ছি।

এদিকে গুলশান ২ এর মূল রাস্তা ছেড়ে ভেতরের দিকের এক সড়কে সিগন্যালে দাঁড়ানো একটি প্রাইভেটকারের কাচ নামিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে মুকিদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি যখন একজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিচ্ছিলেন তখন তাকে ঘিরে ধরেছে আরও ৫-৭ জন ভিক্ষুক। সবাইকেই টাকা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি।

কথা হলে মুকিদুর রহমান বলেন, তিনি গুলশান ২তে বসবাস করেন, পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি আরও বলেন, রমজানে সবাই সওয়াবের আশায় দান খয়রাত বেশি করে, অন্য সময় যদি কেউ দান নাও করে এই রমজান মাসে সে অনেক বেশি দান করে এটাই স্বাভাবিক। সে কারণেই তো রাজধানীতে এ সময় ভিক্ষুক বেড়ে যায়। আমি শুধু গাড়ির কাচ খুলেছি একজন ভিক্ষুককে টাকা দেওয়ার জন্য, কিন্তু আমাকে তাৎক্ষণিক সাত-আট জন ঘিরে ধরেছে। বাধ্য হয়ে সবাইকে টাকা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলাম।

তিনি আরও বলেন, আমি এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করি, এই রাস্তার এ সিগন্যালের সামনেই কমপক্ষে ১৫ জন ভিক্ষুক আজ দেখলাম। অন্য সময় অবশ্যই দুই একজনকে দেখা যেত।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ১৬৭ জন ভিক্ষুককে আশ্রয় কেন্দ্রে প্রেরণ করেছে।

বিগত ২ দিনে রাজধানীর গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকায় ভিক্ষুকমুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করেন ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ।

জানা গেছে, আজও (বৃহস্পতিবার) বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এর আগে গতকাল বুধবার অভিযানে গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ৯৭ জন ভিক্ষুককে এবং এর আগে মঙ্গলবারের অভিযানে ৭০ জন ভিক্ষুককে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুলকার নায়ন বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করার পরও সম্প্রতি ওই সব এলাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গুলশান বারিধারা এলাকায় বিদেশি নাগরিকদের হয়রানি করতে দেখা যায়। আমরা অভিযান শুরু করেছি, এটি অব্যাহত থাকবে।

এ জাতীয় আরও খবর