মঙ্গলবার, ১৪ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জনগণের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমানোর বাজেট চাই

news-image

ড. আতিউর রহমান
গত দুটি বাজেট প্রস্তাবের সময় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করা মুখ্য বিবেচ্য ছিল। তাই হয়তো টিকে থাকার জন্য জরুরি ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য দিকে সেভাবে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু আসন্ন অর্থবছরের (অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর) বাজেটে করোনা মোকাবিলার অভিজ্ঞতার আলোকে এ খাতটি ঢেলে সাজিয়ে আরও গণমুখী করার উদ্যোগ দেখতে চাইছেন সব অংশীজনই। সচরাচর মোট জাতীয় বাজেটের ৫ থেকে ৬ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বাস্থ্য খাতের জন্য। এ অনুপাত অবশ্যই বৃদ্ধি করা দরকার। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখেছি, স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বেড়েছে এর চেয়ে বেশি হারে। এটিকে স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি বরাদ্দের চাহিদার প্রতি নীতিনির্ধারকদের সংবেদনশীলতা হিসেবে দেখা যায়। এর পরও পুরো দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় বেশ কম। জিডিপির শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশের কারেন্ট হেলথ এক্সপেন্ডিচার (সিএইচই) মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মাথাপিছু সিএইচইর হিসাবেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, ভুটান ও শ্রীলংকার চেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশের মাথাপিছু সিএইচই বা স্বাস্থ্য খরচ যেখানে ৪৫ ডলার, সেখানে এই প্রতিবেশী দেশগুলোর যথাক্রমে ৫৮, ৭৩, ১০৩ ও ১০৭ ডলার (২০২০ সালের হিসাব অনুসারে)।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করেই বলা যায়, আমরা স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট ব্যয় করছি না। এর চেয়েও বড় কথা হলো, এই অপ্রতুল স্বাস্থ্য ব্যয়েরও দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসছে নাগরিকদের পকেট থেকে (যাকে বলা হয় আউট অব পকেট কস্ট)। নাগরিকরা নিজেরা স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে ব্যয় করেন, এর আবার বড় অংশটি যাচ্ছে ওষুধ, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ তথা আনুষঙ্গিক চিকিৎসাসামগ্রী বাবদ (৬৭ শতাংশ)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হেলথ ইকোনমিক্স ইউনিটের প্রস্তুত করা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ষষ্ঠ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কাজেই স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি যেমন প্রতিবেশী দেশের ব্যয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সূচকের ভিত্তিতে করা যাচ্ছে, তেমনি নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপের এই পরিসংখ্যান থেকে স্বাস্থ্যের বাড়তি বরাদ্দ কোথায় দিতে হবে, এ সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যায়। যেহেতু ওষুধ কেনা বাবদই নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে, সেহেতু স্বাস্থ্য বাজেটের বর্ধিত বরাদ্দের একটি বড় অংশ নাগরিকদের বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে ওষুধ সরবরাহের জন্য রাখা দরকার। বর্তমানে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ২০ শতাংশের মতো এই উপখাতে যায়। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এই বরাদ্দের অনুপাত দ্বিগুণ করা গেলে স্বাস্থ্য ব্যয়ে নাগরিকদের অংশ ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। তবে এর বিতরণ হতে হবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক।

দেশে স্বাস্থ্যসেবাপ্রার্থীদের বড় অংশটি মূলত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাপ্রার্থী- এটা নিশ্চিত। তবুও মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র এক-চতুর্থাংশের মতো এ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির জন্যও স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বৃদ্ধি করা চাই। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ খাতের বরাদ্দ ব্যয়ের দক্ষতার অভাব একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে এ কথাটি হয়তো বেশি প্রযোজ্য। প্রায়ই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য দেওয়া উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় অর্ধেকই অব্যয়িত থেকে যায়। এটিকে এ খাতে যথাযথ বরাদ্দ না দেওয়ার কারণ হিসেবে দাঁড় না করিয়ে কীভাবে এ খাতে বরাদ্দ বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়, সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে মনে করি। আমার মনে হয়, যে মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দ বাস্তবায়নে দক্ষতা বেশি দেখাচ্ছে, সেগুলোর কাছ থেকে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয় দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। একই সঙ্গে অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেও তা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদে দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির উপযোগী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের পুরো স্বাস্থ্য খাতকেই ঢেলে সাজানো দরকার বলে মনে করেন অনেক অংশীজন। এ জন্য খুব বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস উদ্যোগ এখনই নেওয়া হয়তো ঠিক হবে না। তবে ধীরে ধীরে আমাদের একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তনের পথে হাঁটতেই হবে। তাই মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সংস্কারমূলক নীতিকৌশল বাস্তবায়নের জন্য আমাদের এগোতেই হবে। আমার মনে হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসডিজির স্বাস্থ্যবিষয়ক লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য একটি ৬ থেকে ৮ বছর মেয়াদি সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে। এই পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারের বাইরে থাকা বিশেষজ্ঞদেরও যুক্ত করা যেতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের নাগরিকরা এখনো স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যক্তি খাত ও বেসরকারি খাতের ওপর ব্যাপকমাত্রায় নির্ভরশীল। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এ অংশীজনদের ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রাখার বিকল্প নেই। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে এ রকম একটি সম্মিলিত পরিকল্পনার উদ্যোগের জন্য বরাদ্দ এলে খুব ভালো হয়।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে জনগণের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কী করে কমানো যায়, এদিকটিতেই। বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ বিষয়টির গুরুত্ব আরও বেড়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব সরবরাহ চেইনগুলোয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশও পড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষত কম আয়ের পরিবারগুলো বিপাকে পড়তে শুরু করেছে আমাদের দেশেও। দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো টাকার নিয়ন্ত্রিত অবমূল্যায়ন ও নীতি সুদ হার কমানোর মাধ্যমে বাজারে ঋণপ্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ। কিন্তু এতকিছুর পরও কিছুটা মূল্যস্ফীতি আমাদের নাগরিকদের মোকাবিলা করতেই হবে। পুরো সংকটের সমাধান তো কেবল মনিটারি পলিসি দিয়ে করা যাবে না, ফিসকাল পলিসি তথা বাজেটকেও তার ভূমিকা পালন করতে হবে। এখানেই জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বাবদ বরাদ্দ বৃদ্ধি করার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সরকার নিশ্চয়ই বিপাকে পড়া কম আয়ের নাগরিকদের মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্ট করবে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে যদি নাগরিকদের স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমানো যায়, সেটিও এই দুর্দিনে তাদের জন্য ভীষণ সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই আমার মনে হয়, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁটের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটিকে স্বাগত জানিয়েও খেয়াল রাখতে হবে, স্বাস্থ্য খাতের অতিজরুরি উপখাতগুলো যেন এই কাটছাঁটের শিকার না হয়। একই কথা প্রযোজ্য শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্যও। এখন পর্যন্ত সরকার সংকট মোকাবিলায় সঠিক ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে, এর ভিত্তিতে আসছে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতেও সঠিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে- এমনটিই আশা করছি।

 

ড. আতিউর রহমান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয় সভাপতি