রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফর্মুলার ‘আগ্রাসী বিপণন’ মায়ের দুধে বড় বাধা

news-image

রাশেদ রাব্বি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফ নতুন একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাবা-মা ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ৫১ শতাংশই বলেছেন, তারা ফর্মুলা দুধ তৈরিকারক কোম্পানিগুলোর বিপণন কার্যক্রমের শিকার হয়েছেন। আর বেশির ভাগ কোম্পানি শিশুদের ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন করছে।

‘ফর্মুলা দুধের বিপণন কীভাবে শিশুকে খাওয়ানোর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি বাংলাদেশসহ আটটি দেশে বাবা-মা, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে করা হয়েছে। পদ্ধতিগত ও অনৈতিক বিপণন কৌশল ব্যবহার করে সাড়ে ৫ হাজার কোটি ডলারের ফর্মুলা-দুধ শিল্প কীভাবে শিশুকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, তা এই জরিপে তুলে ধরা হয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ নারী তাদের শিশু ও নবজাতককে পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ান। প্রায় ৬০ শতাংশ নারীকেই ফর্মুলা দুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। যদিও এই নারীদের ৯৮ শতাংশের মাঝেই তাদের শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। মাত্র ৬৫ শতাংশ নারী নবজাতকদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ান।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের উপ-প্রতিনিধি ভীরা মেন্ডনকা বলেন, বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে চান। তবে তারা প্রায়শই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সমর্থন পান না। ফর্মুলা দুধ বিপণনের বার্তাগুলো ভয় ও সন্দেহের বীজ বপন করে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই খাতের বিপণন কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত এবং আক্রমণাত্মক অনলাইন টার্গেটিং; স্পনসরড পরামর্শ প্রদানকারী নেটওয়ার্ক ও হেল্পলাইন। প্রচার ও উপহার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে প্রশিক্ষণ ও সুপারিশসমূহকে প্রভাবিত করার চর্চা। বাবা-মা এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা যে বার্তাগুলো পান, তা প্রায়ই বিভ্রান্তিকর, বৈজ্ঞানিকভাবে অপ্রমাণিত এবং এগুলো মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম (কোড) লঙ্ঘন করে। অথচ এই কোড শিশুখাদ্য তৈরিকারকদের আক্রমণাত্মক বিপণন কার্যক্রম থেকে মায়েদের রক্ষা করতে ১৯৮১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদে পাস হওয়া একটি যুগান্তকারী জনস্বাস্থ্য চুক্তি।

বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট (বিএমএস) কোড পর্যবেক্ষণ বিষয়ে ডব্লিউএইচও-এর নির্দেশিকা সুস্পষ্ট। সেখানে বলা হয়েছে, ফর্মুলা দুধের বাজারজাতকরণ এবং বিপণনের কারণে মায়েরা যেন বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে নিরুৎসাহিত না হয়। ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী বিপণন, বিশেষ করে এই মহামারীর সময়ে মায়ের দুধের বিকল্পের নিরাপত্তার বিষয়ে মিথ্যা তথ্য থেকে পরিবারগুলোকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় আইনের শক্তিশালী প্রয়োগ এবং পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন বাংলাদেশে ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধি ড. বারদান জাং রানা।

বাংলাদেশ, চীন, মেক্সিকো, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামের শহরগুলোতে ৮ হাজার ৫০০ বাবা-মা ও অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং ৩০০ স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর জরিপটি চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে যত নারী জরিপে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের ৮৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৯২ শতাংশ ও চীনের ৯৭ শতাংশ নারী ফর্মুলা দুধের বিপণন ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন, যা তাদের ফর্মুলা বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ড. তেদরোস আধানোম গ্যাব্রিয়াসুস বলেন, এই প্রতিবেদন খুব স্পষ্টভাবে দেখায় যে, ফর্মুলা দুধের বিপণন এখনো ব্যাপকভাবে বিভ্রান্তিকর এবং আক্রমণাত্মক। শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় সুযোগসন্ধানী বিপণনের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা গ্রহণ ও প্রয়োগ আবশ্যক।

জরিপে অন্তর্ভুক্ত সব দেশের নারীরাই তাদের শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে এই হার ৯৮ শতাংশ। তবে কিছু অলীক ধারণা সৃষ্টি করে ফর্মুলা দুধের প্রতি মায়েদের আকৃষ্ট করে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। এগুলো প্রচারণার মধ্যে রয়েছে- জন্মের পর প্রথম দিনগুলোতে ফর্মুলা প্রয়োজন, শিশুর পুষ্টির জন্য বুকের দুধ পর্যাপ্ত নয়, নির্দিষ্ট ফর্মুলা খাদ্যের উপাদানগুলো শিশুর বিকাশ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ফর্মুলা শিশুর পেট দীর্ঘ সময় ধরে ভরা রাখে এবং বুকের দুধের গুণগত মান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘আমরা জানি যে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশু ও মা- উভয়ের জন্যই সর্বোত্তম। আর ফর্মুলা খাবার সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বার্তাগুলো শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করে। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য আমাদের দৃঢ নীতিমালা, আইন ও বিনিয়োগ প্রয়োজন, যাতে নারীরা অনৈতিক বিপণন কার্যক্রম থেকে সুরক্ষিত থাকে।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সব দেশেই বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রচারমূলক উপহার, বিনামূল্যের নমুনা, গবেষণার জন্য তহবিল, অর্থের বিনিময়ে কর্মশালা, ইভেন্ট ও সম্মেলন আয়োজন এবং এমনকি কমিশন দেওয়া হয়, যাতে করে তারা নতুন মায়েদের ফর্মুলায় ঝুঁকতে পরামর্শ দেন। জরিপে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশের বেশি নারী বলেছেন, একজন স্বাস্থ্যকর্মী তাদের কাছে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ফর্মুলা খাবারের বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউনিসেফ ও সহযোগীরা সরকার, স্বাস্থ্যকর্মী ও শিশুখাদ্য তৈরি খাতের প্রতি আক্রমণাত্মক উপায়ে ফর্মুলা দুধ বিপণন বন্ধ করতে এবং এ সংশ্লিøষ্ট কোড বা নীতিমালা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন ও মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

প্রসঙ্গত, বুকের দুধ খাওয়ানো হলে শীর্ণকায় বা স্থূলতাসহ সব ধরনের অপুষ্টির বিরুদ্ধে শিশুদের শরীরে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মায়ের দুধ শিশুর প্রথম টিকা হিসেবেও কাজ করে, যা তাদের শৈশবকালীন অনেক সাধারণ অসুস্থতা থেকে রক্ষা করে। এটি নারীদের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়।

 

এ জাতীয় আরও খবর